দেনমোহর সর্বনিম্ন কত টাকা - দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম

আপনি কি জানেওন বিবাহের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দেনমোহর কত টাকা? আপনি কি এটা জানেন যে,দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম কী? যদি এগুলার উত্তর আপনি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের এই পোস্ট টি আপনার জন্নে। এই পোস্টটা সম্পূর্ণ পড়লে আপনি আপনি জানতে পারবেন দেনমোহর এর সকল বিধান।
                                                                             
দেনমোহর

ভূমিকা

বিয়ে করার রাসূল (সা) সুন্নত. ইসলামী শরীক মোতাবেক কোন ব্যক্তি বিয়ে করলে তাকে অবশ্যই তার স্ত্রীকে মোহরানা দিতে হবে. একজন উপযুক্ত পুরুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী এক থেকে চারটি বিয়ে করতে পারে. আর প্রতিটি বিয়ের ক্ষেত্রেই মোহরানা পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি. তবে আমরা অনেকেই জানিনা এই মহরানা দেওয়ার নিয়ম টা কি এবং সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন কত টাকা ধার্য করা হতে পারে মোহরানা হিসেবে. আর এর ফলে সমাজে নানা রকম কুসংস্কার সৃষ্টি হয়েছে। তাই আজকে এই পোস্ট থেকে আমরা আপনাদেরকে জানাবো দেনমোহর সর্বনিম্ন কত টাকা এবং দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম। তো চলুন দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক দেনমোহর ও এ সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য।

দেনমোহর সর্বনিম্ন কত টাকা

শরয়িত মোতাবেক মোহরের বিধান হলোঃ ১০ দিরহামের বেশি ( অর্থাৎ পৌনে তিন ভরি খাঁটি রুপা)। পৌনে তিন ভরি খাঁটি রুপার মূল্য যখন যা হবে, মোহরের সর্বনিম্ন মূল্যও তখন তাই হবে।যদি আমরা বাংলাদেশের নিয়ম মাপিক যাই তাহলে দেনমোহরের পরিমান যাই হোক না কেন সর্বনিম্ন ফি ২০০ টাকা। তবে এই পরিমাণ টি সরকার বিভিন্ন সময় পরিবরতন করে থাকে।

কাবিন নামা করতে কত টাকা লাগে?

অর্থ আইন এর ধারা ১০ অনুযায়ী নিকাহ বা বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণের জন্য ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে এক হাজার বা উহার অংশ বিশেষের জন্য ১২.৫০ টাকা হারে ফি আদায় করতে পারবে। দেনমোহর ৪ লাখ টাকার অধিক হলে পরবর্তী প্রতি লাখে ১০০ টাকা হারে আদায় করতে হবে।

নিকাহ রেজিস্টার কি?

রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে বিয়ের একটি দলিল। মুসলিম বিবাহ ও তালাক এর আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী, বিয়ে অবশ্যই আইন মোতাবেক রেজিস্ট্রি করতে হবে। আর বিয়ে যিনি রেজিস্ট্রি করেন তাকে আইন অনুযায়ী বলা হয় নিকাহ রেজিস্টার।

কাবিন নামা কি কি কাজে লাগে?

কাবিননামা একটি আইনি দলিল। বাংলাদেশের আইন মোতাবেক সরকার এর দ্বারা মনোনীত কাজী, সরকার নির্ধারিত নিয়মে কাবিননামা সম্পাদন করেন। স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর আদায়, উত্তরাধিকার নির্ণয়, স্ত্রীর ভরণপোষণ, সন্তানের পিতৃত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথাযথভাবে নিবন্ধিত কাবিননামা একটি আইনি দলিল।

মোহরানা আদায় করা কি?

ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক, মহর বা মোহর হল বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা স্বামী বা স্বামীর পিতার পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করতে হয়। বিবাহর ক্ষেত্রে দেনমোহর প্রদান করা বাধ্যতামুলক। ইসলামে,মহরের মাধ্যমেই বিয়েকে বৈধ হিসাবে গণ্য করা হয়।

দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি কি?

দেনমোহর পরিশোধ না করলে তার যথাযোগ্য শাস্তি হলো ১ মাস কারাদণ্ড অথবা ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড অর্থাৎ কারাদণ্ড এবং জরিমানা উভয়ই হতে পারে। তবে স্ত্রী ইচ্ছা করলে তার স্বামী বা স্বামীর উত্তরাধিকারীগণের জন্য দেনমোহরের অর্থ সম্পদ আংশিক কমিয়ে দিতে পারে অথবা সম্পূর্ণ মওকুফ করে দিতে পারে।

তালাকের পর দেনমোহর কি দিতেই হবে?

দেনমোহর বিবাহিত মুসলিম নারীর একটি বিশেষ অধিকার। এই অধিকার মুসলিম আইনের উৎস পবিত্র কুরআন দ্বারা স্বীকৃত। মুসলিম আইন অনুযায়ী দেনমোহর হলো বিয়ের একটি শর্ত এবং স্ত্রীর একটি আইনগত অধিকার। এই অধিকার বলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে কিছু পরিমাণ অর্থ বা সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারী হয়৷ দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ স্বরূপ এবং অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। বিবাহের সময় প্রতিদানস্বরূপ বর কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিতে সম্মত অথবা গৃহীত কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে মোহর বলে। বিবাহের সময়ে বা পূর্বে এই দেনমোহর স্থির হয়। অবশ্য পরেও করা যেতে পারে।

ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী মোহর আদায় প্রতিটি স্বামীর জন্য ফরজ।দেনমোহর স্বামীর জন্য একটি ঋণ, সর্বাবস্থায় দেনমোহর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক।

লাহোর ও এলাহাবাদ হাইকোর্ট দেনমোহরকে স্ত্রীর মর্যাদাস্বরূপ বলে বিচার করেছেন – অর্থাৎ এটি হল আইনগত স্ত্রীর প্রাপ্য মার্যাদা। বিবাহ-চুক্তিতে যদি লেখাও থাকে দেনমোহর দিতে হবে না – সেক্ষেত্রেও দেনমোহর স্ত্রীর প্রাপ্য। অন্যপক্ষে কলকাতা হাইকোর্টের মতে, দেনমোহর হলো সম্পত্তির মূল্য।

মুসলিম আইনে দেনমোহর স্ত্রী প্রতি সম্মান প্রদর্শন হিসাবে স্বামীর উপর আরোপিত একটি দায়িত্ব মাত্র। দেনমোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ (21 DLR) মামলার বিচারপতি দ্বারা সিদ্ধান্তে বলা হয়ার, ‘সহবাসের পূর্বে এবং পরে স্ত্রী স্বামীর কুরবেতার প্রাপ্য মোহরান দাবি করতে পারে এবং স্বামী উক্ত দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্ত্রী তার স্বামীর অধিকারে অর্থাৎ সহবাসে যেতে স্ত্রী অস্বীকার করতে পারেন।’ 

এ অজুহাতে স্বামী স্ত্রী থেকে দূরে অবস্থান করলে তা পরিশোধে বাধ্য। (11 DLR WP) লাহোর 124। স্বামী এহেন মোহরানা পরিশোধ ব্যতীত দাম্পত্য অধিকারের ডিক্রি পেতে পারে না। যে কোন বিষয় সম্পত্তি মোহরানার জন্য ধার্য করা যায় না। ইহা হতে পারে নগদ অর্থ, কোন বীমা পলিসি বা অন্য কোন দ্রব্য সামগ্রী। তবে কোন হারাম বস্তু হতে পারবে না। স্বামীর দখলে নেই এমন কোন সম্পত্তি পারে না। ভবিষ্যত কোন বিষয়ও এর অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে না।

দেনমোহরের পরিমাণ কিভাবে নির্ধারন করা হয়?

দেনমোহরের পরিমান সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া হয়নি। তাই তা আপেক্ষিক।সাধারণত দেখা যায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। বিষয়গুলো হলো:
  • স্ত্রীর পারিবারিক অবস্থা ও বংশ মর্যাদা
  • স্ত্রীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা
  • স্ত্রীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং
  • স্ত্রী এর পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের (যেমন – বোন,ফুফু, খালা, ) দেনমোহরের পরিমাণ।
অপর দিকে বরের আর্থিক ক্ষমতার দিকটাও বিবেচনায় রাখা হয়। এসব দিক বিচার বিবেচনা করেই মূলতঃ দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না তবে স্বামী ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন।

১৯৬১ সালের পারিবারিক আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী দেনমোহর দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে কাবিনে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলেও স্ত্রী চাওয়ামাত্র সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত থাকলেও এর কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত নেই।

তবে সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হল বিয়ের দিন নির্ধারণ করার পূর্বে উভয় পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে ধার্য্য করা। বর নিজেই এ চুক্তি করতে পারে। এই দেনমোহর দাম্পত্য মিলন, তালাক-বিচ্ছেদ অথবা স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যুর দ্বারা নিশ্চিত হয়।
দেনমোহরের বাবদ দেয়া অর্থ বা সম্পদ কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
“তাৎক্ষনিক” যাহা চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য এবং অপরটি“বিলম্বিত” দেনমোহর-যাহা মৃত্য অথবা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ পরিশোধযোগ্য।স্ত্রী কি তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর আগে দেনমোহর দাবি করতে পারে?

তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর আগেই স্ত্রী দেনমোহর দাবি করতে পারে এবং স্বামী তখন নির্ধারিত দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ তাই যে কোনো সময় স্ত্রী তা দাবি করতে পারে। স্বামী দাম্পত্য মিলনের পূর্বে স্ত্রীকে তালাক দিলে দেনমোহরের পরিমাণ অর্ধেক হইবে। কিন্তু দাম্পত্য মিলনের পূর্বে স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দেনমোহরে প্রদান করিতে হইবে।

স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রী কি ভাবে দেনমোহর আদায় করবে?

মৃত মুসলমানের উত্তরাধিকারীগণ দেনমোহর ঋণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নহে। মুসলিম আইনে ৪৩ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুর নিকট প্রাপ্য অনগদ ঋণের ন্যায়-দেনমোহর ঋণের উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর সম্পত্তিতে প্রাপ্য অংশের আনুপাতিক হারে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী দায়ী হবে। যদি স্বামীর উত্তরাধিকারীরা স্বামীর সম্পত্তি থেকে দেনমোহর দিতে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন

এই আইনের এর মধ্যে ধারা ১০ এ মোহরানা বা দেনমোহর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, নিকাহ বা বিবাহের কাবিননামায় কি ধরনের দেনমোহর স্ত্রীর পাওনা হবে, তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা না থাকলে দেনমোহরের পুরো অর্থ বা সম্পদ স্ত্রী চাওয়ামাত্রই পরিশোধযোগ্য। সালিশী পরিষদের আদেশ বলে এটি কার্যকর হলে স্ত্রীর তা পাওনা হয়ে যায়। পরিশোধ না করলে ১ মাস কারাদণ্ড বা ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

দেনমোহরের মামলা ও তামাদী আই

স্ত্রী বাসস্থানটি যে আদালতের আত্ততাভূক্ত, স্ত্রী সেখানেই মামলাটি দায়ের করতে পারবে, বিখ্যাত মামলা তুলনা দিতে পারি এই ক্ষেত্রে শাহ বানু বেগম বনাম ইফতেখার মাহমুদ খান (1957) 2 WP 748, (56) P, kar, 363 এবং 22 DLR-677 মামলায় বলা হয়েছে, দেনমোহর কখনই মাফ হয় না। স্বামী যদি মারাও যায় তবে সে স্বামীর সম্পদ হতে দেনমোহর আদায় করা যায়। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পর যদি স্ত্রী সমুদয় অথবা শুধুমাত্র বিলম্বিত দেনমোহরের অর্থ অনাদায়ী থেকে থাকে। তবে স্ত্রী তার প্রয়াত স্বামীর ভূ-সম্পত্তি দখল করত উহার রাজস্ব বা মুনাফা হতে তা উসুল করতে পারে।

উল্লেখ্য, যদি স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয় এবং স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা ঐ দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। ফলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা দেনমোহর পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করতে পারবেন। কেননা ইসলামী আইনে দেনমোহরকে দেনা বলে বিবেচনা করা হয়। দেনমোহরের পরিমাণ যত বেশি হোক না কেন, পক্ষগুলোর মধ্যে স্বীকৃত হলে স্বামী তা সম্পূর্ণ রূপে স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। এমনকি স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও আদালত দেনমোহরানার দায় হতে স্বামীকে মুক্তি দেবে না।

শেষ কথা

দেনমোহর সর্বনিম্ন কত টাকা? দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম, তালাকের পর দেনমোহর আদায়ের নিয়ম, দেনমোহন নির্ধারণের পদ্ধতি এবং আইন এর সকল বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এই পোষ্টের মধ্যে। আশা করা যায় এই পোষ্টের মাধ্যমে আপনি আপনার কাঙ্খিত তথ্য এবং আপনার প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজে পেয়েছেন। যদি এই পোষ্টের মাধ্যমে আপনি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই শেয়ার করে দিবেন যাতে অন্যরাও এই পোষ্টের মাধ্যমে তাদের কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান অর্জন করতে পা্রে। আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে ফেসবুক পেজ ইমেইল অথবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন। আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url